মাদক রোধে একশন প্ল্যান: ২২ পরিকল্পনার দুটি বাস্তবায়ন

নাজিম মুহাম্মদ •

মাদকের ভয়াবহ বিস্তার বন্ধ করতে আট বছর মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা (একশন প্ল্যান) হাতে নিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ। স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘ তিনমেয়াদে সতেরোটি পরিকল্পনার খসড়া ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে সুরক্ষা বিভাগ।

এতে এক বছরের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১৫টি, দুই বছরের মধ্য মেয়াদি পাঁচটি ও পাঁচ বছরের দীর্ঘমেয়াদি দুটিসহ ২২টি কর্মপরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা বিস্তার ঠেকাতে সরকার বিশেষ এ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার সময়সীমা শেষ হয়েছে। দুটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেও অধিকাংশ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে এখনও আলোর মুখে দেখেনি।

এক বছরের স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা : স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনায় যে পনেরোটি বিষয়ের উপর কাজ করার কথা বলা হয়েছে। তা হলো- ১.সীমান্তপথে মাদকের প্রবেশ বন্ধ করতে বাংলাদেশের মাছ ধরার নৌকাগুলোকে ভিন্ন রং করা এবং মিয়ানমারের নৌকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিশ্চিত করা। কোস্টগার্ড বিষয়টি তদারকি করবেন।

২.আন্তঃবাহিনীর সমন্বয়ে জেলা ও মেট্রো এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হবে। পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা পৃথকভাবে এ তালিকা তৈরি করবে।

৩. তালিকার ভিত্তিতে একযোগে জেলা ভিত্তিক টাস্কফোর্সের যৌথঅভিযান চালানো হবে। তালিকাভুক্ত সকল মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। অভিযানে যেসব কর্মকর্তার কর্মক্ষমতা খারাপ হবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

৪. ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে প্রশাসনের ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ করে তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হবে। প্রত্যেকে জেলায় দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন।

৫. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়ে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।

৬. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করা হবে।

৭. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। চারটি বিভাগীয় শহরে রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট নিরাময়কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।

৮. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিটি জেলা অফিসে পর্যাপ্ত জনবল ও যানবাহন বাড়ানো হবে।
৯. সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে প্রচার ও উদ্ধুদ্বকরণ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।

১০. মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর পাঁচ শয্যার সরকারি নিরাময় কেন্দ্র করে ২৫ শয্যায় উন্নীত করার পাশাপাশি বেরসকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে তদারকির আওতায় নিয়ে আসা হবে।
১১. পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি বিভাগের একটি উপজেলাকে মাদকমুক্ত করা।
১২. সরকারি বেসরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে মেডিকেল ফিটনেস পরীক্ষায় মাদকাসক্ত কিনা তাও পরীক্ষা করা হবে।
১৩. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।
১৪. জাতীয় শিক্ষা একাডেমিতে মাদক বিরোধী উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।

১৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় মাদকের খারাপ দিকগুলো আলোচনায় এনে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা।

কোস্টগার্ড টেকনাফ জোনের জোনাল কমান্ডার লে. কর্নেল সাদ তাইম জানান, আমি যোগদান করেছি এক মাসের কিছু বেশি দিন হয়েছে। এখানে মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে রং করা হয়েছে। তবে মিয়ানমার সীমানায় এসব বোটের মাছ ধরার কোন সুযোগ নেই। রংবিহীন বোট সীমান্ত এলাকায় যায় না। দূরত্বও বজায় রাখা হয়।

কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিন এলাকার জোনাল কমান্ডার লে. কর্নেল সাদ তাইম জানান, মাছ ধরা নৌকাগুলোকে চিহ্নিত করতে আলাদা রং করা হয়েছে। মিয়নমার সীমানায় মাছ ধরার বাংলাদেশি নৌকার মাছ ধরার কোন সুযোগ নেই। রংবিহীন বোট সীমান্ত এলাকা যেতে দেয়া হয় না।

দুই বছরের মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা : মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনায় পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তা হলো-
১. সীমান্তপথে মাদকের প্রবেশ রোধ করতে ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ মিয়ানমার স্থল সীমান্তে সীমান প্রাচীর দেয়া হবে।

২. অ্যালকোহল, সরকারি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনার বিধিমাল প্রণয়ন করা।

৩. দ্রুত সময়ের মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অদিদপ্তরের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।

৪. চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ডোপটেস্ট (মাদকাসক্ত টেস্ট) চালু করা হবে।

৫. চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ২৭টি জেলায় বেসকরারি উদ্যেগে নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ব্যক্তি ও এনজিওকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হবে। কারণ উক্ত ২৭ জেলায় বর্তমানে কোন মাদকাসক্তদের নিরাময় কেন্দ্র নেই ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মেট্রোর সহকারী পরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, সীমান্তে সীমান প্রাচীর এখনো হয়নি। এলকোহল ও ডোপ টেস্টের বিধিমালা প্রণয়ন শেষ পর্যায়ের। ২০০ শয্যার মাদকসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলে সহকারী পরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, মাদক পাচার রোধে সীমান্ত এলাকায় সীমানা প্রাচীর এখনো দেয়া হয়নি। তবে এলকোহল ও ডোপটেস্ট বিধিমালা প্রণয়ন শেষ পর্যায়ে। বিভাগীয় শহরের নিরাময় মাদকসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো ২৫ শয্যার করা হয়েছে।

দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা : পাঁচ বছরের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তা হলো-
১. অবকাঠামো উন্নয়নের আওতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর, খুলনা ও ময়মনসিংহে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় নির্মাণ হবে। ২০২১ সালের জুনমাসের মধ্যে মাদকদ্রব্য প্রশিক্ষণ একাডেমি, চারটি বিভাগীয় শহরে রাসায়নিক, সাতটি বিভাগীয় শহরে ২০০ শয্যার নিরাময় কেন্দ্র, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা হবে।

২. ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যার মাদকসক্তি ওয়ার্ড চালু করা হবে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় প্রতিটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার ওয়ার্ড চালু করা হবে। জাতীয় মানসিক রোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ৫০ শয্যার স্থলে ১০০ শয্যা ও ৩০ শয্যার পাবনা মানসিক হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হবে।